জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর কোন ধারণা নয়, এটি বাস্তবতা। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়ছে জনস্বাস্থ্যে, অর্থনীতিতে। আর এর প্রভাব রয়েছে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তেই। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী করা হয় কার্বন নিঃসরণকে। জাতিসংঘ বলছে, কার্বন নিঃসরণের জন্য যেসব পদক্ষেপ নেবার কথা ছিলো দেশগুলোর, সেসব অপর্যাপ্ত। ফলে ধারণা করা হচ্ছে এই শতকের শেষ নাগাদ বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা মানবজাতির জন্য হবে নারকীয়।

অথচ জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছিলো, বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে হবে। এজন্য সব দেশকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। যদি দেশগুলো তাদের সব প্রতিশ্রুতি রক্ষাও করে তবুও গড় তাপমাত্রা বাড়বে প্রায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

কিন্তু বাস্তব চিত্র পুরোটাই ভিন্ন। পরিসংখ্যান বলছে, উন্নত দেশের জোট জি 20 মিলে ৮০ ভাগ কার্বন উৎপাদন করছে। অথচ আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলো একত্রে ৪ ভাগেরও কম কার্বন নিঃসরণ করছে। ২০২২ সালে জীবাশ্ম জ্বালানী নির্ভর কল-কারখানা ৯০ ভাগের বেশি কার্বন নিঃসরণ করেছে।

অক্সফামের এক গবেষণার তথ্য বলছে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১ ভাগ অতি ধনী মানুষ, যারা সংখ্যায় ৭ কোটি ৭ লাখ , তারা মোট কার্বন নিঃসরণের ১৬ ভাগ কার্বন নিঃসরণ করছে, যারা ৬৬ ভাগ বা ৫১১ কোটি দরিদ্রতম মানুষের চেয়েও বেশি কার্বন নিঃসরণ করছে। অথচ এইসব দরিদ্রতম মানুষগুলোই কার্বন নিঃসরণের কারণে ক্ষতিকর প্রভাবের মুখোমুখি হচ্ছে। এই এক শতাংশ মানুষের কারণে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে, তা থেকে সৃষ্ট গরমে আসছে দশকে বিশ্বে ১০ লাখ মানুষ মারা যেতে পারে। অক্সফামের প্রতিবেদন অনুযায়ী এই ১ শতাংশ অতি ধনী মানুষের উপর ৬০ শতাংশ কর আরোপ করা গেলে বছরে ৬ লাখ ৪০ হাজার ডলার তহবিল পাওয়া যাবে, যা জলবায়ু বৈষম্য দূর করতে সহায়ক হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস সদস্যের প্রতি চার জনের এক জন জীবাশ্ম জ্বালানী চালিত কারখানার সাথে জড়িত, যার আর্থিক মূল্য ৩৩ মিলিয়ন থেকে ৯৩ মিলিয়ন ডলার। এছাড়া উত্তর গোলার্ধের দেশগুলো ২০২০ সালে জীবাশ্ম জ্বালানী খাতে ১.৮ ট্রিলিয়ন ডলার ভর্তুকি দিয়েছে।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে, যে পরিমাণ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে তাতে বাংলাদেশের ১৭ ভাগ জমি বিলীন হয়ে যাবে এবং ২০ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে।

ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সহায়তায় তৈরি করা হয় অ্যাডাপটেশন বা অভিযোজন তহবিল। উন্নত দেশগুলা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো এই তহবিলে তারা বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করবে, অর্থ আসবে সরকারি ও বেসরকারি খাত থেকে। কিন্তু উন্নত দেশগুলো তাদের সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি।

জাতিসংঘের প্রতিবেদন বলছে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব আরও বেড়েছে, ফলে অর্থের চাহিদা বেড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে অর্থের চাহিদার পরিমাণ হবে ৩০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এছাড়া বেসরকারি খাত এই তহবিলে অর্থ দান করতেও ইচ্ছুক নন।

জাতিসংঘ বলছে ২০১৮-২০২০ সালে এই অভিযোজন ফান্ডে অর্থ দেবার যে প্রবাহ ছিলো তা ২০২১ সালে ১৫ শতাংশ কমে যায়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্থানীয় অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিবছর লাগবে ৩৮৭ বিলিয়ন ডলার, আর এই অর্থায়ন আসতে হবে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে।
জাতিসংঘ বলছে, যদি ১ বিলিয়ন ডলার উপকূলীয় এলাকায় বিনিয়োগ করা যায়, তাহলে ১৪ বিলিয়ন ডলারের বন্যার অর্থনৈতিক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। যদি ১৬ বিলিয়ন ডলার কৃষিখাতে বিনিয়োগ করা যায়, তাহলে ৭ কোটি ৮০ লাখ মানুষ চরম ক্ষুধা থেকে নিস্তার পাবে।

এরই মধ্যে আলোচনা এসেছে লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড, এই তহবিল থেকেও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে দেয়া হবে ক্ষতিপূরণ। যেটি গেলো বছর কপ ২৭ এ গঠন করা হয়েছে। এই তহবিলের জন্য প্রয়োজন ১০০ ট্রিলিয়ন ডলার, কিন্তু এই পরিমাণ অর্থায়ন কীভাবে হবে তা এখনও নিশ্চিত নয়। ট্রানজিশনার কমিটি ঐক্যমত্য হয়েছে যে আগামী চার বছরের জন্য এই তহবিলের দায়িত্ব থাকবে বিশ্বব্যাংকের হাতে, যদিও এ নিয়ে রয়েছে মতভেদ।